গ্রিনল্যান্ড দখলে নিতে ট্রাম্প কেন এত মরিয়া
ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ড নিয়ে চলমান বিতর্কের মাঝেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেখানে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহেই এই সফর হতে পারে, যা নিয়ে গ্রিনল্যান্ডের রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
এর আগে ট্রাম্প স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও গ্রিনল্যান্ডকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চান তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন বক্তব্যের পর প্রতিনিধিদল পাঠানোর ঘটনাকে ‘অত্যন্ত আগ্রাসী’ হিসেবে দেখছেন গ্রিনল্যান্ডের নেতারা।
ট্রাম্প বরাবরই গ্রিনল্যান্ডের প্রতি তাঁর আগ্রহ গোপন করেননি। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে তিনি একাধিকবার দ্বীপটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার বিষয়ে অর্থনৈতিক লেনদেন কিংবা সামরিক শক্তি ব্যবহারের হুমকি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
গ্রিনল্যান্ডের নেতারা এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের এই অভিপ্রায়কে দৃঢ়ভাবে, তবে বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে আসছেন। তাঁদের বার্তা একটাই—গ্রিনল্যান্ড বিক্রির জন্য নয়।
‘সেকেন্ড লেডি’র সফর ও তীব্র প্রতিক্রিয়া
এ সপ্তাহে মার্কিন প্রতিনিধিদলের সম্ভাব্য গ্রিনল্যান্ড সফরকে কেন্দ্র করে বিতর্ক আরও বেড়েছে। সফরের নেতৃত্বে থাকবেন ‘সেকেন্ড লেডি’ উষা ভ্যান্স, সঙ্গে থাকবেন হোয়াইট হাউসের নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওলাৎজ ও জ্বালানিমন্ত্রী ক্রিস রাইট।
গ্রিনল্যান্ডের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মিউট এগেদে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, পার্লামেন্ট নির্বাচনের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে এই সফর ‘অত্যন্ত আক্রমণাত্মক’ এবং এটি ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি কৌশল মাত্র। তাঁর আশঙ্কা, এ সফরের পর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ আরও বাড়বে।
ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড নিয়ে এত আগ্রহ কেন?
কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান
গ্রিনল্যান্ডের অধিকাংশ এলাকা আর্কটিক অঞ্চলে অবস্থিত, যা বর্তমানে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলের অনুত্তোলিত প্রাকৃতিক সম্পদ ও উদীয়মান সামুদ্রিক বাণিজ্য পথের কারণে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো এখানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।
আর্কটিক অঞ্চলের বরফ গলার ফলে নতুন বাণিজ্যপথ তৈরি হয়েছে, যা একসময় কার্যত অপ্রবেশ্য ছিল। মার্কিন নৌ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, সুয়েজ বা পানামা খালের পরিবর্তে আর্কটিক অঞ্চলের পথ ব্যবহার করলে এশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যপথ প্রায় ৪০% পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত করা সম্ভব। ফলে প্রশ্ন ওঠে—এই গুরুত্বপূর্ণ নৌপথের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে?
আর্কটিক অঞ্চলের ওপর সার্বভৌমত্ব দাবি করতে পারে মাত্র পাঁচটি দেশ—কানাডা, রাশিয়া, নরওয়ে, ডেনমার্ক (গ্রিনল্যান্ড) ও যুক্তরাষ্ট্র (আলাস্কা)। গ্রিনল্যান্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে আরও বড় দাবি তুলে ধরতে পারবে।
জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘গ্রিনল্যান্ড আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ মার্কিন কংগ্রেসে দেওয়া সাম্প্রতিক ভাষণে তিনি বলেন, ‘এই ভূখণ্ড সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অপরিহার্য।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই গ্রিনল্যান্ডে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি রয়েছে। সেখানে রয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ঘাঁটি পিটুফিক স্পেস বেস, যা একসময় থুলে বিমানঘাঁটি নামে পরিচিত ছিল। ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে এই ঘাঁটির পুনর্নকশা করেছিলেন এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের ‘গোল্ডেন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ট্রাম্প বলেছেন, চীনের সম্ভাব্য হুমকি প্রতিহত করতে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথকে আগামী ২৮ মার্চের মধ্যে পরিকল্পনা প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা
আর্কটিক অঞ্চলে রাশিয়া ও চীনের উপস্থিতি ক্রমেই বাড়ছে। রাশিয়া ইতিমধ্যেই সেখানে ব্যাপক সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। চীনও আর্কটিক অঞ্চলের সামুদ্রিক বাণিজ্যপথের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, যা মার্কিন স্বার্থের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ট্রাম্প চান, যুক্তরাষ্ট্র যাতে এ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়ে এবং গ্রিনল্যান্ডকে নিজেদের কৌশলগত অবস্থানের অংশ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
0 Comments